একসময় যিনি ছিলেন সমালোচনার পাত্র, পরে তিনিই হয়ে ওঠেন বিপদের দিনে একমাত্র নিশ্চিন্ত আশ্রয়স্থল। আর যিনি এই আশ্রয় পেয়েছিলেন তিনি হলেন মধুকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। একসময় তিনি বন্ধু রাজনারায়ণকে চিঠিতে বিদ্যাসাগরে নিয়ে ব্যঙ্গ করেছিলেন। কিন্তু পরে বিদ্যাসাগর ও মধুকবির বন্ধুত্ব হয়ে উঠেছিল নিবিড়। বিদ্যসাগরকে নিয়ে তাই মধুসূদন পরে লিখেছিলেন, ‘বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে।/ করুণার সিন্ধু তুমি, সেই জানে মনে,/ দীন যে, দীনের বন্ধু !– উজ্জ্বল জগতে’। তিক্ততা থেকে কীভাবে এই বন্ধুত্ব গড়ে উঠল তা এক ইতিহাস বটে।
এই ঘটনার সূত্রপাত একটি কাহিনিকে ঘিরে। আর সেটি হল ‘তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য’। ১৮৬০ সালের মে মাসে প্রকাশিত হয় এই কাব্য। যেটির বিরূপ সমালোচনা করেছিলেন বিদ্যাসাগর। সেইসময় সমাজ সংস্কারের পথে নেমেছেন তিনি। তার শিক্ষার দ্যুতি তিনি ছড়িয়ে দিচ্ছেন সমাজের প্রতিটি কোণায়। এদিকে বিদ্যাসাগরের এমন সমালোচনায় বেশ ক্ষুব্ধ হলেন মাইকেল। তিনি মনে করলেন, সমস্ত পন্ডিত অবজ্ঞাভরে কাব্য নিয়ে বিচার করেন।
আরও পড়ুন,
*আচমকা মঞ্চে লুটিয়ে পড়লেন বর্ষীয়ান কবি, হৃদরোগে মৃত্যু, দেখুন সেই ভিডিও
*১০০ বছর পার, ফের তৃতীয় বারের জন্য বিয়ে সারলেন এক প্রৌঢ়
কারণ মাইকেল নিজে বেশ আত্মবিশ্বাসী ছিলেন তার লেখা নিয়ে। তাই বিদ্যাসাগরের এমন মন্তব্য সহজভাবে নিতে পারলেন না তিনি। এরপরই বন্ধু রাজনারায়ণকে চিঠি লিখলেন মাইকেল। সেখানেই বিদ্যাসাগরের প্রতি মাইকেলের ক্ষোভ প্রকাশ পেলো স্পষ্ট। জানা যায়, এই দ্বন্দ্ব চলেছিল প্রায় তিন মাস। এদিকে পরে মাইকেলের লেখাতেই অভাবনীয় প্রতিভাকে খুঁজে পান বিদ্যাসাগর। তার উল্লেখ মেলে মাইকেলের চিঠিতেই। মাইকেলের মধ্যে থাকা প্রতিভাকে ঠিক চিনেছিলেন বিদ্যাসাগর।
সেবছরই মাইকেল জানান বিদ্যাসাগরের মূর্তি গড়াতে নিজের পারিশ্রমিকের অর্ধেক তিনি দিয়ে দিতে রাজি। এতেই স্পষ্ট হয় তাদের সম্পর্কের সমীকরণ আরও মধুর হয়েছে। এভাবেই একে অপরের বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন তারা। এরপর ১৮৬২ সালের ৯ই জুন ব্যরিস্টারি পড়তে ইউরোপ যান মাইকেল। এদিকে তিনি বিদেশ যাওয়ার পর দেশ থেকে টাকা পাঠানো বন্ধ হয়ে যায়। ধীরে ধীরে দেনার দায়ে গলা পর্যন্ত ডুবে যাওয়ার জোগাড় মাইকেলের। যেকোনো সময় তার জেল হতে পারে। সেইসময় তিনি বিদ্যসাগরকে চিঠি লিখলেন।
চিঠিতে তার করুণ অবস্থার কথা জানিয়ে টাকা চাইলেন মাইকেল। তখন ১৮৬৪ সালের ২রা জুন। বিদেশে পড়তে আসার পর মাত্র দুই বছর কেটেছে তখন। চিঠিতে তিনি বিদ্যাসাগরকে লিখলেন, “তুমিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি আমাকে এই যন্ত্রণাদায়ক পরিস্থিতি থেকে মুক্তি দিতে পারে।” এরপর সেই চিঠি পেয়ে বিদ্যাসাগর মাইকেলকে দেড় হাজার টাকা পাঠান যা ওইসময় এক বিরাট অংকের টাকা ছিল। এরপর চিঠি ও টাকা পাঠানো জারি ছিল বিদ্যাসাগরের। অনেক সমস্যা অতিক্রম করে, ঋণ করে এই টাকা জোগাড় করতেন বিদ্যাসাগর।
আরও পড়ুন,
*এলোমেলো চুল, একমুখ দাড়ি নিয়ে মলিন কাপড়ে রাস্তায় ঘুরে বেরাচ্ছেন দেব, দেখুন সেই ভিডিও
*বিয়ের আগেই অন্তঃসত্ত্বা তিয়াশা রায়! জল্পনা শুরু হয়েছে চারিদিকে
এদিকে ১৮৬৪ সালে ফ্রান্সে একটি বইয়ের দোকানে বিদ্যাসাগরের কয়েকটি বই দেখতে পান মাইকেল। আর তা নিজের চিঠিতে তুলতেও ভোলেন না তিনি। যা থেকে বোঝা যায় গোটা বিশ্বে বিদ্যাসাগরের ব্যপ্তি ছড়িয়ে পড়েছিল। বইয়ের দোকানে বিদ্যাসাগরের বই দেখে মাইকেল দোকানিকে জানান, লেখক তার পরম বন্ধু। এটি থেকেই স্পষ্ট হয় বিদ্যাসাগর ও মাইকেলের মধ্যেকার সম্পর্ক। এরপর ১৯৬৭ সালে ব্যারিস্টার হয়ে দেশে ফেরেন মাইকেল। এরপর ধীরে ধীরে বন্ধুদের সঙ্গে মদ্যপানের নেশায় ডুবে যান তিনি। এমন সময়েও বন্ধুর পাশে থেকেছেন বিদ্যাসাগর।
বিদ্যাসাগরকে তার জন্য গালমন্দ সইতে হত। কিন্তু তাতেও সম্পর্কে ফাটল ধরেনি তাদের। তবে জানা যায়, শেষপর্যন্ত নিজের সম্পত্তি বিক্রি করেও মাইকেল বিদ্যাসাগরের ঋণ শোধ করেছিলেন। জীবনের প্রতি মোড়ে দারিদ্র্যতা এসে হানা দিয়েছে মাইকেলকে। সেভাবে নিজের জীবনে বিশেষ সফলতার স্বাদ তিনি পাননি। তবে বাঙালির মনে তিনি গেঁথে থাকবেন তার অনন্য সৃষ্টি ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ রচনার মধ্যে দিয়ে। এর পাশাপাশি বিদ্যাসাগর ও মাইকেল মধুসূদন দত্তের এই বন্ধুত্ব যা এক অসামান্য বন্ধুত্বের ইতিহাস হয়ে থেকে যাবে।
আরও পড়ুন,
বিদেশের মাটিতে মৃত্যু ভারতীয় ছাত্রের, মৃত্যুর কারণ অধরা
*অপেক্ষার অবসান! কবে মুক্তি পাচ্ছে ‘পুষ্পা ২’? জানালেন আল্লু অর্জুন