দক্ষিণ কলকাতার কসবা থানা এলাকার এক হোটেল থেকে উদ্ধার হওয়া চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট আদর্শ লোসালকার বিবস্ত্র দেহ ঘিরে চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে শহরজুড়ে। তদন্তে উঠে আসছে ডেটিং অ্যাপকে কেন্দ্র করে সাজানো ভয়ঙ্কর প্রতারণা ও খুনের জাল। পুলিশ জানিয়েছে, ঘনিষ্ঠতার বিনিময়ে মাত্র দু’হাজার টাকা দাবি করলেও প্রকৃত লক্ষ্য ছিল আদর্শের কাছ থেকে কমপক্ষে ২০ হাজার টাকা হাতানো। সেই টাকার জন্যই আদর্শকে খুন করেছে অভিযুক্ত যুগল—কোমল সাহা ও তার লিভ-ইন পার্টনার ধ্রুব মিত্র।
ঘনিষ্ঠতার নাম করে ফাঁদ পাতা
পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, গত বৃহস্পতিবার ডেটিং অ্যাপে কোমল আদর্শের সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং দু’হাজার টাকার বিনিময়ে ‘ঘনিষ্ঠতা’র প্রস্তাব দেয়। অভিযোগ, আদর্শ সেই টাকা না দিলেও অনলাইনেই কসবার হোটেলে দুটি ঘর বুক করেন। প্রথমে কোমল ও ধ্রুব একসঙ্গে একটি ঘরে ঢোকেন, তার কিছু পরে কোমল চলে যান আদর্শের ঘরে।
সিসিটিভি ছবিতে দেখা যায়, আদর্শ নিজেই বিয়ারের বোতল ও চিপস কিনে ঘরে প্রবেশ করছেন। এর পরপরই করিডরে দীর্ঘক্ষণ কোমল ও ধ্রুবকে আলোচনা করতে দেখা যায়। তদন্তকারীদের মতে, সেখানেই গড়ে ওঠে লুঠপাট ও খুনের নীলনকশা।
মদ খাইয়ে অচেতন করে মারধর
পুলিশ জেনেছে, আদর্শ আগেই বিয়ার পান করছিলেন। কোমল তাঁকে আরও মদ্যপান করতে উৎসাহিত করেন। অতিরিক্ত মদে ঝিমিয়ে পড়তেই কোমল পাশের ঘর থেকে ধ্রুবকে ডেকে আনেন। অভিযোগ, দু’জন মিলে আদর্শের পকেট থেকে প্রায় দেড় হাজার টাকা লুঠ করে। সেই সময় জেগে ওঠেন আদর্শ এবং ধ্রুবকে দেখে আপত্তি জানান।
অভিযুক্তদের বক্তব্য—আদর্শকে বারবার অনলাইনে ২০ হাজার টাকা দিতে চাপ দেওয়া হয়, কিন্তু তিনি রাজি হননি। উলটে কোমলকে গালিগালাজ করেন। এর পরই ধ্রুব ঘুষি মেরে আদর্শের নাক ফাটিয়ে দেন। আদর্শও পাল্টা প্রতিরোধ করলে দু’জনে মিলে তোয়ালে দিয়ে তাঁর পা বেঁধে ফেলে ও গলা চেপে ধরে। ধস্তাধস্তির সময় আদর্শের নখের আঁচড় ধ্রুবর হাতে স্পষ্ট চিহ্ন রেখে যায়।
বেডশিটের ফাঁসেই মৃত্যু
পুলিশের দাবি, মারধরের পর কোমল ও ধ্রুব বিছানার বেডশিট খুলে এনে আদর্শের গলায় ফাঁস লাগায়। অচেতন অবস্থায় তাঁকে বিছানা থেকে মেঝেয় ফেলে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়। রাত দেড়টা–দুটোর মধ্যে পুরো ঘটনাটি ঘটে। এরপর সিসিটিভিতে ধরা পড়ে কোমল–ধ্রুবর করিডরে দৌড়াদৌড়ি ও পাশের ঘরে যাওয়া। পরে কোমল নিজের ব্যাগ নিয়ে ধ্রুবর সঙ্গে হোটেল ছাড়েন।
হাত বদল বয়ান, নতুন রহস্য
গ্রেপ্তারের পর থেকেই কোমল ও ধ্রুব একাধিকবার বয়ান বদলাচ্ছেন। কখনও আলাদাভাবে, কখনও মুখোমুখি বসিয়ে পুলিশ তাদের জেরা করছে। ঘটনার পুনর্গঠনও চলছে। পুলিশের অনুমান, আদর্শ-খুনের ঘটনায় লুঠপাটই মূল উদ্দেশ্য। তাছাড়া ডেটিং অ্যাপের মাধ্যমেই ভিনরাজ্যের আরও কয়েকজনকে টাকা হাতানোর অভিযোগ রয়েছে এই যুগলের বিরুদ্ধে।
তদন্তের মূল ফোকাস সময়সীমা
শুক্রবার রাত সাড়ে এগারোটা থেকে বারোটা পর্যন্ত আদর্শ, কোমল ও ধ্রুবের একসঙ্গে উপস্থিতি এখন পুলিশের তদন্তের কেন্দ্রে। কারণ রাত ১২টার কিছু পরেই ঘটেছে আদর্শের মৃত্যু। ঠিক কী ঘটেছিল সেই ঘণ্টাখানেকের মধ্যে—সেটাই জানতেই তদন্তকারীদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।
আরও পড়ুন
মায়াপুর যাত্রা আরও সহজ! শিয়ালদহ–আমঘাটা নতুন লিংক ট্রেনের সময়সূচি প্রকাশ
কোমল–ধ্রুবের স্বীকারোক্তি, সিসিটিভি ফুটেজ, লুঠ হওয়া টাকা ও শারীরিক সংঘর্ষের চিহ্ন—সব মিলিয়ে পুলিশ নিশ্চিত, পরিকল্পনা করে ডেকে নিয়ে খুন করা হয়েছে চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট আদর্শ লোসালকারকে। তদন্ত এগোচ্ছে লুঠ ও পূর্বপরিকল্পিত হত্যার ধারা মেনে।
