রাজ্যজুড়ে এখন ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধন (SIR) প্রক্রিয়া চলছে। উদ্দেশ্য—ভোটার তালিকা আরও নির্ভুল করা, ‘ভুত’ বা অযোগ্য ভোটারদের শনাক্ত করা এবং যোগ্য কোনও নাগরিক যাতে তালিকা থেকে বাদ না পড়ে তা নিশ্চিত করা। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় প্রশ্ন উঠতেই কমিশন এবার আরও কঠোর অবস্থান নিল। প্রথমবারের মতো পশ্চিমবঙ্গে পাঠানো হচ্ছে পাঁচ জন যুগ্মসচিব পর্যায়ের আইএএস আধিকারিককে—বিশেষ পর্যবেক্ষক বা স্পেশাল রোল অবজারভার হিসেবে।
ভুত ভোটার খুঁজতে আরও কড়াকড়ি
সূত্রের খবর, এসআইআর প্রক্রিয়ায় নজরদারি বাড়াতে কমিশনের নির্দেশে এই পাঁচ আধিকারিক রাজ্যে এসে বিভিন্ন ডিভিশনের দায়িত্ব নেবেন। গণনা, নোটিস, শুনানি থেকে শুরু করে চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ—সব ক্ষেত্রেই তাঁরা কড়া নজরদারি করবেন। কমিশন জানিয়েছে অ্যাপ্রুভাল, ভেরিফিকেশন বা শুনানির কোনও ধাপ যেন নিয়মবহির্ভূত না হয়, তা দেখাই তাঁদের মূল দায়িত্ব।
কোন ডিভিশনে কে দায়িত্বে?
কমিশন ইতিমধ্যেই পাঁচ আধিকারিকের নাম ঘোষণা করেছে—
প্রেসিডেন্সি ডিভিশন: কুমার রবিকান্ত সিং (যুগ্মসচিব, প্রতিরক্ষা দপ্তর)
মেদিনীপুর ডিভিশন: নিরজ কুমার বনসোড় (যুগ্মসচিব, স্বরাষ্ট্র দপ্তর)
বর্ধমান ডিভিশন: কৃষ্ণ কুমার নিরালা (যুগ্মসচিব, তথ্য ও সম্প্রচার দপ্তর)
মালদা ডিভিশন: অলক তিওয়ারি (যুগ্মসচিব, অর্থ দপ্তর)
জলপাইগুড়ি ডিভিশন: পঙ্কজ যাদব (যুগ্মসচিব, গ্রামোন্নয়ন দপ্তর)
এই আধিকারিকরা এসআইআর প্রক্রিয়ার শেষ দিন পর্যন্ত বাংলায় অবস্থান করবেন। নোটিশ ইস্যু, শুনানি পরিচালনা, মাঠপর্যায়ের কাজ, চূড়ান্ত তালিকা—সবই প্রতি মুহূর্তে পর্যালোচনা করবেন তাঁরা।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশ্ন ও অভিযোগ
এসআইআর নিয়ে এর আগে একাধিকবার আপত্তি তুলেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর অভিযোগ—
পর্যাপ্ত পরিকাঠামো ছাড়াই বিশাল দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে বিএলওদের।
দ্রুততার সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে বহু ক্ষেত্রে ভুল হওয়ার আশঙ্কা থাকছে।
আবেদন ও শুনানির যথাযথ পরিবেশ নেই।
এসআইআর পর্যায়ের অভিযোগ ও সমস্যা নিয়ে তৃণমূলের ১০ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদলও সম্প্রতি কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করেছে।
নবান্ন বনাম কমিশন সংঘাতের প্রেক্ষাপট
কিছুদিন আগেই ভোটার তালিকায় কারচুপির অভিযোগে চার আধিকারিককে সাসপেন্ড ও এফআইআর করার নির্দেশ দেয় নির্বাচন কমিশন। অভিযুক্তরা—
দেবোত্তম দত্ত চৌধুরী (ইআরও, বারুইপুর পূর্ব)
তথাগত মণ্ডল (সহকারী এইআরও)
বিপ্লব সরকার (ইআরও, ময়না)
সুদীপ্ত দাস (এইআরও)
এছাড়া ডেটা এন্ট্রি অপারেটর সুরজিৎ হালদারের বিরুদ্ধেও অভিযোগ ওঠে। এই ঘটনার জেরে নবান্ন ও কমিশনের মধ্যে প্রবল টানাপোড়েন তৈরি হয়, এমনকি মুখ্যসচিব মনোজ পন্থকে দিল্লিতে ডেকে ‘চাপ’ দেওয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ ওঠে।
তাহলে কি এসআইআরের পরেও রয়ে যাচ্ছে ‘ভুত’ ভোটার?
পাঁচ বিশেষ পর্যবেক্ষক নিয়োগকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক মহলে প্রশ্ন—
এত কড়াকড়ি সত্ত্বেও কি অযোগ্য নাম থেকে যাচ্ছে তালিকায়?
নাকি প্রশাসনিক পর্যায়ে বারবার খামতি ধরা পড়ছে?
অভিযোগ যাই হোক, কমিশন এবার স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে—ভোটার তালিকায় কোনও ধরনের অনিয়ম বরদাস্ত হবে না। প্রতিটি বয়ান, প্রতিটি আবেদন, প্রতিটি শুনানি এখন সর্বোচ্চ স্তরের নজরদারিতে।
রাজ্যের রাজনৈতিক পরিবেশ আরও উত্তপ্ত হওয়ার ইঙ্গিত মিলছে। একদিকে কমিশনের কঠোরতা, অন্যদিকে সরকারের আপত্তি—এসআইআর প্রক্রিয়া কেন্দ্রীয় ও রাজ্য প্রশাসনের সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছে। আগামী দিনে এই বিশেষ পর্যবেক্ষকদের ভূমিকা কতটা প্রভাব ফেলবে, এখন সেই দিকেই তাকিয়ে রাজ্যবাসী।