একসময় রসায়নবিদদের স্বপ্ন ছিল সাধারণ ধাতুকে সোনায় রূপান্তরিত করা—আলকেমির যুগে যাকে ‘দারুশিলা’ খোঁজার চেষ্টা বলা হতো। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান দেখিয়েছে, উপাদান রূপান্তর কোনও রহস্যময় প্রক্রিয়া নয়; এটি সম্পূর্ণ পারমাণবিক বিজ্ঞান দ্বারা সম্ভব। তবে এই প্রক্রিয়া যতটা বৈজ্ঞানিকভাবে আকর্ষণীয়, বাণিজ্যিকভাবে ততটাই অসম্ভব।
উচ্চশক্তির কণা রশ্মিতে ধাতু থেকে সোনা
বর্তমান পারমাণবিক-পদার্থবিদ্যা প্রমাণ করেছে যে ভারী উপাদানগুলো—যেমন বিসমাথ, পারদ বা সীসা—কে প্রোটন-নিউট্রন ভেঙে সোনার আইসোটোপে রূপান্তর করা সম্ভব। এজন্য ব্যবহার করা হয় উচ্চশক্তির কণা রশ্মি এবং বিশেষায়িত কোলাইডার। তবে এখানে উৎপাদিত সোনা এতটাই ক্ষুদ্র পরিমাণে থাকে যে তা মাপার জন্য লাগে বিশেষ যন্ত্র।
CERN-এর সাফল্য: সোনা উৎপাদন হলেও অতি নগণ্য পরিমাণ
১৯৮০-এর দশক থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে CERN-এর লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারের (LHC) ALICE পরীক্ষায় সীসা থেকে সোনার নিউক্লিয়াস তৈরি করা সম্ভব হয়েছে।
২০২৫ সালে CERN আরও নির্ভুলভাবে দেখায় যে ‘আল্ট্রা-পেরিফেরাল’ সংঘর্ষে সীসা-২০৮ নিউক্লিয়াস থেকে তিনটি প্রোটন ছিটকে গিয়ে সাময়িকভাবে তৈরি হচ্ছে সোনা-২০৩।
পরীক্ষায় প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ৮৯,০০০ সোনার নিউক্লিয়াস উৎপাদন সম্ভব হলেও, বহু বছর ধরে মোট উৎপাদিত সোনার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে মাত্র ২৯ পিকোগ্রাম।
এই পরিমাণের বাজারমূল্য শূন্যের কাছাকাছি, অথচ খরচ বহু কোটি ডলার।
পারদের আইসোটোপ থেকে সোনা: তাত্ত্বিকভাবে সম্ভব
বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন, পারদের নির্দিষ্ট আইসোটোপে নিউট্রন প্রয়োগ করলে তা অস্থির হয়ে ক্ষয়প্রক্রিয়ায় সোনা-১৯৭-তে পরিণত হতে পারে—যা সোনার স্থিতিশীল রূপ।
২০২৫ সালে একটি ফিউশন-স্টার্টআপ প্রস্তাব দেয় ফিউশন নিউট্রন ব্যবহার করে পারদ-১৯৮ থেকে পারদ-১৯৭ হয়ে সোনা তৈরির ধারণা।
কিন্তু এই প্রযুক্তি এখনও গবেষণার প্রাথমিক স্তরেই রয়েছে, এবং শক্তি ও যন্ত্রপাতির খরচ সোনার দামের বহু গুণ বেশি।
সোনার মত দেখতে ধাতু তৈরি করা গেলেও ‘সোনা’ তৈরি নয়
প্রকৃত সোনা উৎপাদন যত ব্যয়বহুল, সোনার মতো রঙ বা টেক্সচার তৈরি করা ততটাই সহজ।
আয়রন পাইরাইট (বোকার সোনা) স্বাভাবিকভাবে সোনার মতো দেখতে।
পিতল বা অন্যান্য সোনালি সংকর ধাতু চেহারায় সোনার মত হলেও রাসায়নিকভাবে সম্পূর্ণ ভিন্ন।
এসব সংকর ধাতু উপাদান পরিবর্তন নয়, কেবল রঙ অনুকরণ করে।
কেন সোনা তৈরির সব পদ্ধতি অব্যবহারযোগ্য?
পারমাণবিক রূপান্তরের মাধ্যমে সোনা তৈরির সব প্রচেষ্টা হয়—
অতি ব্যয়বহুল
জটিল
কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত গবেষণাগার নির্ভর
এবং উৎপাদন অত্যন্ত ক্ষুদ্র পরিমাণে
সুতরাং, আধুনিক প্রযুক্তি সোনা তৈরি করতে পারলেও তা কোনওভাবেই বাণিজ্যিক বা ব্যবহারিক নয়। এটি কেবলমাত্র বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার অংশ এবং মানবজাতির পারমাণবিক বিজ্ঞানের অগ্রগতির প্রতীক।