পুজো ও দীপাবলির মরশুমে প্রতিবছরই বিপুল পরিমাণ আতশবাজি বাজেয়াপ্ত করে পুলিশ। এ বছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি। কিন্তু একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ক্রমেই জোরালো হয়ে উঠছে—বাজেয়াপ্ত হওয়া সেই আতশবাজি, তার মশলা বা সংশ্লিষ্ট রাসায়নিক উপকরণের পরিণতি ঠিক কী হয়?
নিয়ম বলছে, জনবহুল এলাকা এড়িয়ে নির্দিষ্ট সাইটে আতশবাজি পরিবেশবান্ধব ও বৈজ্ঞানিক উপায়ে ধ্বংস করতে হয়। ‘হ্যাজ়ার্ডাস ওয়েস্ট’ হিসেবে আতশবাজির বর্জ্য ধ্বংসের জন্য রয়েছে কঠোর বিধিও। কিন্তু পরিবেশকর্মীদের অভিযোগ, বাস্তবে সেই বিধি মানা হচ্ছে না। বরং বিভিন্ন থানায় বাজেয়াপ্ত বাজি দীর্ঘদিন ফেলে রাখা হচ্ছে এবং পরে তা কোথায়, কী ভাবে নষ্ট করা হচ্ছে, তার কোনও স্বচ্ছ নথি নেই।
পরিবেশ অ্যাকাডেমির চিঠি: কঠোর ব্যবস্থার দাবি
পরিবেশ–বিষয়ক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা পরিবেশ অ্যাকাডেমি রাজ্যের ডিজি, কলকাতা পুলিশ কমিশনার, পরিবেশ দপ্তর এবং দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদকে চিঠি দিয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি করেছে। সংস্থার সভাপতি ও দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের প্রাক্তন চিফ ল’অফিসার বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায় জানান, বিভিন্ন জেলায় বাজেয়াপ্ত আতশবাজি নদীর ধারে ফেলে দেওয়া হচ্ছে—যা পরিবেশ সুরক্ষা আইন ও পর্ষদের নির্দেশিকার সরাসরি বিরোধী।
“এটা জননিরাপত্তা এবং পরিবেশ— দুইয়ের ক্ষেত্রেই বিপজ্জনক,” অভিযোগ বিশ্বজীৎ মুখোপাধ্যায়ের।
নৈহাটির বিস্ফোরণ স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে সতর্কবার্তা
২০১৯ সালে উত্তর ২৪ পরগনার নৈহাটিতে বাজেয়াপ্ত বাজি গঙ্গার ধারে নষ্ট করতে গিয়ে ঘটে ভয়াবহ বিস্ফোরণ। একাধিক বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, গঙ্গার ওপারে হুগলিতেও কম্পন অনুভূত হয়। সেই ঘটনার পর ২০২০ সালের ১৫ জানুয়ারি দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ নির্দেশ দেয়—আতশবাজিকে ‘হ্যাজ়ার্ডাস ওয়েস্ট’ হিসেবে বিবেচনা করে Hazardous Waste Management Rules 2016 অনুযায়ী হলদিয়া সাইটে তা ধ্বংস করতে হবে।
কিন্তু পরিবেশকর্মীদের দাবি, বিধি জারি হলেও বাস্তবে তা মানা হয়নি, এখনো হচ্ছে না।
বাজেয়াপ্তের পরিমাণ বিশাল, তবু নেই নজরদারি
পুলিশ সূত্রে খবর, এই মরশুমে কলকাতা, হাওড়া ও বিধাননগর মিলিয়ে বাজেয়াপ্ত আতশবাজির পরিমাণ প্রায় ৬ হাজার কেজি। অন্যান্য জেলাতেও আটক বাজির পরিমাণ কম নয়। অথচ সেগুলির সঠিক সংরক্ষণ বা ধ্বংসের নিয়ম মানা হচ্ছে কি না—তার কোনও নিরপেক্ষ নথি নেই পুলিশের কাছেই।
পরিবেশকর্মীদের আশঙ্কা, অবৈজ্ঞানিকভাবে এ ধরনের রাসায়নিক বর্জ্য ফেলে দিলে তা—
মাটি ও জলাশয়ে বিষাক্ত রাসায়নিক ছড়ায়
বাতাসে দূষণ বাড়ায়
যেকোনও সময়ে বিস্ফোরণের ঝুঁকি তৈরি করে
বেহাত হয়ে অপরাধে ব্যবহারের সম্ভাবনা থাকে
রাজ্যের কাছে রিপোর্ট প্রকাশের দাবি
সংস্থার দাবি, বাজেয়াপ্ত আতশবাজি নিয়ে রাজ্য সরকারকে একটি বিস্তারিত রিপোর্ট প্রকাশ করতে হবে, যেখানে থাকবে—
মোট বাজেয়াপ্ত বাজির পরিমাণ
কোন থানায় কীভাবে তা সংরক্ষণ করা হচ্ছে
কোথায় এবং কী উপায়ে তা ধ্বংস করা হচ্ছে
এই নথি পুলিশের প্রয়োজনে আদালতেও কাজে লাগবে।
নজরদারি বাড়লে কমবে বিপদ
বিশ্বজীৎ মুখোপাধ্যায় জানিয়েছেন, পুলিশের কাছে নির্দেশ যাওয়া জরুরি যাতে কোনও ভাবেই নদীর ধারে বা জনবহুল এলাকায় বাজি ফেলে দেওয়া না হয়। পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদকে সম্পূর্ণ প্রক্রিয়ার উপর কঠোর নজরদারি বজায় রাখতে হবে।
পুজো শেষ হয়েছে, দীপাবলিও পেরিয়ে গিয়েছে। কিন্তু বাজেয়াপ্ত আতশবাজির সঠিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গিয়েছে। পদ্ধতিগত অবহেলা যদি চলতেই থাকে, তাহলে তার মূল্য দেবে পরিবেশ এবং নাগরিকদের নিরাপত্তা—দু’টোই।
