হুগলির শ্রীরামপুরের রাজ্যধরপুর নেতাজি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে ইতিহাসের শিক্ষিকা সুপর্ণা মুখোপাধ্যায় গড়ে তুলেছেন এক অবিশ্বাস্য নজির। সাড়ে ২৮ বছরের দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনে একদিনও ছুটি নেননি তিনি। বৃষ্টি–ঝড়–ধর্মঘট–মহামারী—কোনও পরিস্থিতিই তাঁর স্কুলযাত্রা থামাতে পারেনি। ১৯৯৭ সালের ২ মে যোগদানের পর থেকে ৩১ অক্টোবর অবসর নেওয়ার দিন পর্যন্ত উপস্থিতির এই ধারাবাহিকতা সত্যিই বিরল।
অবসরের পরেও থেমে যাননি সুপর্ণা। স্কুলে শিক্ষকস্বল্পতা মেটাতে তিনি এখন বিনা বেতনে পড়িয়ে চলেছেন ছাত্রীদের। তাঁর কথায়, “এটা আমার কাছে একটা চ্যালেঞ্জ ছিল। ঈশ্বর সহায় থাকায় পেরেছি। স্কুলই আমার সব।”
অসুস্থতা?—‘আমল দিইনি’
দীর্ঘ সময়ে একবারও কি অসুস্থ হননি? সুপর্ণা বলেন, “হলেও আমল দিইনি। স্কুলে গিয়েছি। পড়িয়েছি। দায়িত্বই সব।” পশ্চিমবঙ্গের তিন মুখ্যমন্ত্রী বদলেছেন, সমাজ-অর্থনীতির চিত্র পাল্টেছে—কিন্তু সুপর্ণার অভ্যাস বদলায়নি।
মাতৃত্ব, সংগ্রাম ও শিক্ষাদানের পথ
দুর্গাপুরেই তাঁর জন্ম ও স্কুলজীবন। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে স্নাতকোত্তর এবং চন্দননগর সরকারি কলেজ থেকে বিএড সম্পন্ন করেন। প্রথম চাকরি গিরিডির সেনা পাবলিক স্কুলে। পরে বিয়ের পরে হাওড়ার আমতায় থাকতেন। ঠিক সেই সময় অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় শ্রীরামপুরের স্কুলে চাকরির সুযোগ আসে। সদ্যোজাত কন্যাকে পরিচারিকার কাছে রেখে স্কুলে যাওয়া—তখন মনখারাপ হলেও পিছিয়ে যাননি তিনি।
তারকা জীবনের মতো অধ্যবসায়—এই শব্দেই যেন ব্যাখ্যা হয় তাঁর পথচলা।
কন্যাও এখন শিক্ষিকা
অনেকে বলেন, কন্যার শৈশব হয়তো কিছুটা ব্যাহত হয়েছে। সুপর্ণার স্বীকারোক্তি, “হয়তো একটু হয়েছে। কিন্তু সে নিজের মতো করে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে।”
চন্দননগরের সেন্ট জোসেফ কনভেন্ট থেকে পড়াশোনা শেষে মেয়েও এখন ইতিহাস নিয়ে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করে একটি বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে শিক্ষকতা করছেন।
সহকর্মীদের চোখে সুপর্ণা
বিদ্যালয়ের প্রধানশিক্ষিকা শর্মিষ্ঠা চন্দ বলেন, “ওঁকে দেখে মাথা হেঁট হয়ে আসে। কোনও কাজেই চিন্তা করতে হয় না—কারণ জানি সুপর্ণাদি আছেন। ২২ বছর ধরে দেখছি, কখনও সময়ের আগে বেরিয়ে যাননি, কখনও ছুটি নেননি।”
যখন কর্মজীবনে ছুটি নেওয়া অনেকের কাছে স্বাভাবিক, তখন সুপর্ণার অদম্য নিষ্ঠা এক অনন্য উদাহরণ।
দায়িত্ব, দৃষ্টি ও বিরল অধ্যবসায়
সাড়ে ২৮ বছরে পেরিয়েছেন ২৮টি শীত, অসংখ্য প্রতিকূলতা। তবুও তাঁর রুটিন থেকে বাদ পড়েনি স্কুল। অবসর-পরবর্তী সময়েও শিক্ষিকার আসন ছেড়ে না যাওয়াই তাঁর চরিত্রের আসল পরিচয়।
সুপর্ণা শুধু একজন শিক্ষিকা নন—তিনি দায়িত্ববোধ, আত্মনিবেদন এবং পেশার প্রতি গভীর ভালবাসার জীবন্ত প্রতীক। দেশজুড়ে যেখানে শিক্ষকস্বল্পতা, অনুপস্থিতি ও প্রশাসনিক সমস্যা নিয়ে বারবার প্রশ্ন ওঠে, সেখানে সুপর্ণার কর্মনিষ্ঠা ভবিষ্যতের শিক্ষকদের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।
আরও পড়ুন
SIP বনাম এককালীন বিনিয়োগ: ১৫ বছরে রিটার্নে বিপুল ব্যবধান, কোন পথ বেশি লাভজনক?
