রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় জনবসতিতে স্মার্ট মিটার বসানোর কাজ শুরু হওয়ার পর থেকেই জনতার মধ্যে প্রশ্ন, বিভ্রান্তি এবং আন্দোলনের আবহ তৈরি হয়েছিল। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠায় গত জুন মাসে রাজ্যের বিদ্যুৎ দফতর বিজ্ঞপ্তি জারি করে জানিয়ে দেয়—অস্থায়ীভাবে বন্ধ রাখা হচ্ছে স্মার্ট মিটার বসানোর কাজ। তবে আধুনিক প্রযুক্তির গতিবেগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এই উদ্যোগ যে শেষ পর্যন্ত চালু হবেই, তা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন দফতরের আধিকারিকরা।
স্মার্ট মিটার আসলে কী?
স্মার্ট মিটার একটি আধুনিক ইলেকট্রনিক ডিভাইস, যা সাধারণ মিটারের মতোই বিদ্যুৎ খরচ পরিমাপ করে। তবে বিশেষত্ব হলো—এটি গ্রাহক ও বিদ্যুৎ সংস্থার কাছে রিয়্যাল টাইম ডেটা পাঠায়। ফলে বাড়ি বাড়ি গিয়ে কর্মীদের মিটার রিডিং সংগ্রহের দরকার পড়ে না। বিদ্যুতের পাশাপাশি গ্যাস ও জলের ক্ষেত্রেও এখন স্মার্ট মিটার ব্যবহৃত হচ্ছে।
কেন এই উদ্যোগ?
২০০৩ সালের মিটার রেগুলেশন বিল থেকে শুরু করে ২০২০ সালের সংশোধনী—এই সবকিছুর ভিত্তিতেই ২০২৪ সালে প্রকাশিত গেজেট বিজ্ঞপ্তিতে বিদ্যুৎ গ্রিড আধুনিকীকরণের প্রথম ধাপ হিসেবে স্মার্ট মিটার স্থাপন বাধ্যতামূলক করার পথ তৈরি হয়েছে। মূল লক্ষ্য—অটোমেশন, স্বচ্ছতা ও মানবসম্পদের সাশ্রয়।
প্রিপেড নাকি পোস্টপেড—কী হবে নিয়ম?
স্মার্ট মিটার মানেই ‘আগে টাকা পরে বিদ্যুৎ’—এই ধারণা ভুল। বিদ্যুৎ দফতর স্পষ্ট জানাচ্ছে, প্রিপেড বা পোস্টপেড—যে কোনোটাই গ্রাহকের পছন্দ অনুযায়ী। কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।
শুরু করেও কেন বন্ধ হল কাজ?
দফতরের মতে, গ্রাহকদের মধ্যে পর্যাপ্ত সচেতনতা তৈরি না হওয়ায় বিভ্রান্তি ছড়ায়। ভুল তথ্য ও গুজবের জেরে কিছু এলাকায় অশান্তিও হয়। তাই আপাতত সাধারণ মানুষের বাড়িতে মিটার বসানোর কাজ স্থগিত। তবে সরকারি দফতর এবং মোবাইল টাওয়ারে স্মার্ট মিটার স্থাপন চলছে।
ভবিষ্যতে কি বাধ্যতামূলক হবে?
অ্যানালগ বা পুরোনো প্রযুক্তির মিটার উৎপাদন ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। যেমন সাদা-কালো টিভি আজ বিরল, তেমনই অ্যানালগ মিটারও বিলুপ্তপ্রায়। তাই প্রশ্নের সরাসরি উত্তর না দিলেও দফতরের বক্তব্য পরিষ্কার—স্মার্ট মিটারই এখন সময়ের দাবি।
স্মার্ট মিটারের সুবিধা
রিয়্যাল টাইমে নির্ভুল তথ্য, মানব-ত্রুটি নেই
মিটার রিডিংয়ের জন্য আলাদা কর্মীর প্রয়োজন নেই
প্রিপেড–পোস্টপেড দুই ব্যবস্থাই চালু
‘আনুমানিক বিল’ বিতর্কের অবসান
মিটার নষ্ট হলে দ্রুত শনাক্তকরণ ও বদল
সোলার প্যানেল সংযোগেও একই মিটার
বাজেট অনুযায়ী বিদ্যুৎ খরচ নিয়ন্ত্রণের সুযোগ
বিলিং প্রক্রিয়া আরও স্বচ্ছ ও সহজ
তাহলে আপত্তি উঠল কেন?
সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচুর ভুল তথ্য ছড়িয়ে পড়ে—
বিল নাকি অস্বাভাবিক বাড়ছে
রিডিং ভুল দেখাচ্ছে
সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার আশঙ্কা
দফতরের দাবি, অভিযোগগুলি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে—একটিতেও বাস্তব প্রমাণ নেই। বরং কিছু অসাধু ব্যক্তির প্ররোচনায় সাধারণ মানুষের মধ্যে ভুল ধারনা ছড়িয়ে পড়েছিল। তবে দফতরও স্বীকার করছে—সচেতনতা প্রচারে নিজেদের ঘাটতি ছিল।
বিদ্যুতের খরচ কি বাড়বে?
দফতর স্পষ্ট বলছে—না।
স্মার্ট মিটার বসানো সম্পূর্ণ বিনামূল্যে
সরকারির ভর্তুকি আগের মতোই থাকবে
প্রিপেড মডেলে অতিরিক্ত ৩% ছাড়ও মিলবে
বেসরকারি সংস্থার ভূমিকা?
সরকার দাবি করছে—স্মার্ট মিটার বসানো, তত্ত্বাবধান ও রক্ষণাবেক্ষণ সম্পূর্ণভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহকারী সংস্থার অধীনে। সরাসরি বেসরকারি হস্তক্ষেপ নেই। যদিও কিছু সংগঠনের অভিযোগ—“পিছনের দরজা দিয়ে বেসরকারিকরণ চলছে”—দফতর তা অস্বীকার করেছে।
রক্ষণাবেক্ষণ কতটা সহজ?
বিশেষজ্ঞদের মতে, সাধারণ মিটারের তুলনায় স্মার্ট মিটারের রক্ষণাবেক্ষণ আরও সহজ, দ্রুত ও নির্ভরযোগ্য।
উপসংহার
স্মার্ট মিটার নিয়ে বিতর্ক এখনো শেষ হয়নি, তবে প্রযুক্তির অগ্রগতির দুনিয়ায় এর প্রয়োগ যে অবশ্যম্ভাবী—তা পরিষ্কার। সচেতনতা, স্বচ্ছতা এবং সঠিক তথ্য পৌঁছে দিতে পারলে আপত্তির মেঘ কেটে যাবে বলেই মনে করেন বিদ্যুৎ দফতরের কর্তারা।
